নিজস্ব প্রতিবেদক,
গাজীপুর মহানগরের কাশিমপুর থানাধীন সারদাগঞ্জ কাজী মার্কেট এলাকায় এক ভয়ঙ্কর আর্থ-সামাজিক সংকটের জন্ম দিয়েছে মাদক ব্যবসায়ী ও সুদখোর আলম মিয়া। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করে তিনি গরিব, অসহায়, দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন থেকে চুষে নিচ্ছেন রক্ত ঘামা টাকা। এলাকাবাসী বলছে—এটি আর সাধারণ সুদের ব্যবসা নয়, এটি একটি অবৈধ অর্থনৈতিক নিপীড়ন ব্যবস্থাপনা, যার মূল অস্ত্র হচ্ছে ভয়, হুমকি, গালিগালাজ ও নৃশংসতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, আমার ভাবির অপারেশনের জন্য খুব দ্রুত ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন ছিল। আমি নিরুপায় হয়ে আলম মিয়ার পোষা সন্ত্রাসী মোঃ আফসার আলীর কাছে সাহায্য চাই। উনি আমাকে বলেন, ২০ হাজার টাকা নিতে হলে প্রতিদিন ৬০০ টাকা সুদ দিতে হবে। আমি অনুরোধ করি যেন মাসে ৪ হাজার টাকা লাভ দেই, কিন্তু তারা জোর করে আমাকে প্রতিদিন ৬০০ টাকা দিতে বাধ্য করে এবং প্রতি সপ্তাহে ৪২০০ টাকা জোর পূর্বক নেয়, টাকা দিতে অল্প সময় বিলম্ব হলে জীবন নাশের হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা নেয়। এতে করে শুধু এক মাসেই আমি ১৮ হাজার টাকা সুদ দিয়েছি। এখন ঋণ ও লাভাংশ মিলে এতটাই কষ্টে আছি যে, আরও ঋণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। প্রতিদিন তারা ফোন দিয়ে গালিগালাজ করে, হুমকি দেয়, ভয়ভীতি দেখায়।”
এই ধরনের উচ্চ সুদ এবং চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায় স্পষ্টত বেআইনি এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। Usurious Loans Act, 1918 এবং Bengal Money-Lenders Act, 1933 অনুযায়ী সীমার অতিরিক্ত সুদ গ্রহণ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া, ভয়ভীতি ও জোরপূর্বক টাকা আদায়ের মতো কাজ বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ধারা 384 ও 385 অনুযায়ী ‘Extortion’ বা চাঁদাবাজির অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, এবং ধারা 506 অনুযায়ী প্রাণনাশের হুমকি একটি ফৌজদারি অপরাধ।
আলম মিয়ার বিরুদ্ধে শুধু সুদের কারবার নয়, রয়েছে ভয়াবহ মাদক ব্যবসার অভিযোগও। স্থানীয়দের মতে, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮–এর ধারা 36 ও 41 অনুযায়ী, এই ধরনের অপরাধের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এলাকাবাসী আরও অভিযোগ করে বলেন, তার নামমাত্র পান, সুপারি ও ডিমের ব্যবসা কিন্তু আলম মিয়া মাদক ও সুদের টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ—বাড়ি, প্লট, দোকান ও নগদ ব্যালেন্স। অথচ তার আয়ের বৈধ কোনো উৎস নেই। ফলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধিত ২০১৯) অনুযায়ী, এই অর্থের উৎস তদন্ত করে বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন।
এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে গেলেই তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর লোকেরা এসে ভয়ভীতি দেখায়। ফলে অধিকাংশ মানুষ মুখ বন্ধ করে সহ্য করে যাচ্ছে। অথচ এভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ (আইনের সুরক্ষা) ও ৩২ (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা) প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রশাসনের নীরবতা এই অপরাধ চক্রকে আরও শক্তিশালী করছে। অনেক সময় থানায় অভিযোগ দিলেও তারা ব্যবস্থা নেয় না। ফলে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—“আইন কি শুধু ধনীর জন্য? গরিবের জন্য কোথায় ন্যায়বিচার?”
এলাকাবাসীর দাবি তিনটি:
১. দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের মাধ্যমে আলম মিয়ার সম্পদ জব্দ
২. পুলিশি অভিযানে তার সন্ত্রাসী বাহিনীসহ গ্রেপ্তার
৩. অবৈধ সুদের আদায় বন্ধ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা
বিকল্প হিসেবে তারা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে হাইকোর্টে রিট দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
একজন বৃদ্ধা দিনমজুর কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
সুদের আগুনে পুড়ছি, আমাদের বুক ফাটে কিন্তু কথায় আসে না। প্রশাসনের পানি কই?”
কাশিমপুর আজ শুধু একটি এলাকা নয়, এটি হয়ে উঠেছে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরীক্ষাগার। এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে শুধু কাশিমপুর নয়—পুরো সমাজই একদিন এই ভয়াল ‘সুদের আগুনে’ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।