নিজস্ব প্রতিবেদক,
স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন জীবন—মেহেদির রঙও রয়ে গেছে হাতে। অথচ এক মাসের মাথায় জীবনের সব আলো নিভে গেল। সে শুধু জরিনা বেগম নয়, সুন্দরগঞ্জের পাঁচটি পরিবার একসঙ্গে হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে—কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, আবার কেউ বেদনার তীব্র চাপে শেষ করে দিয়েছে নিজেকে।
মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে (১৬ ও ১৭ জুন) গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় পাঁচটি মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব মৃত্যুর পেছনে কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং সমাজ ও সম্পর্কের গভীর সংকটও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সোমবার (১৬ জুন) গভীর রাতে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ (সরকারপাড়া) গ্রামে নববধূ জরিনা বেগম (১৮) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
জরিনা এক মাস আগে বিয়ে হয় মুন্নাফ মিয়ার সঙ্গে। তার বাবার বাড়ি উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার গ্রামে।
সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. আব্দুল হাকিম আজাদ জানান, "মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে তদন্ত চলছে। অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হয়েছে।"
একই রাতে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী চম্পা আক্তার (১৪) বিষপান করে আত্মহত্যা করে।
সে সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক সর্বানন্দ গ্রামের বাসিন্দা ও খাজেমুল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ছাত্রী।
চম্পার অভিযোগ, প্রেমিক শাকিল মিয়া ধর্ষণের পর বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে সে বিষপান করে। মৃত্যুর আগে মোবাইলে দেওয়া ভিডিও বার্তায় ঘটনার বিস্তারিত জানায়।
তার মা বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেন। ওসি হাকিম আজাদ বলেন, “আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।”
মঙ্গলবার (১৭ জুন) বিকেলে বেলকা ইউনিয়নের পূর্ব বেলকা গ্রামে কবির হোসেনের শিশু পুত্র আলিফ হোসেন (২) পুকুরে ডুবে মারা যায়।
মা আয়েশা বেগম গোসল করিয়ে উঠানে রেখে ঘরে গেলে, শিশুটি সবার অগোচরে পুকুরে পড়ে যায়।
পরে ভেসে থাকতে দেখে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
সকালেই সর্বানন্দ ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা মনমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জাম পাড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে মারা যান ডেবিট মিয়া (৫০)।
তিনি রামভদ্র গ্রামের বাসিন্দা ও শামসুল হক ব্যাপারীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, জামগাছে উঠে পাড়ার সময় মগডাল ভেঙে পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
বুধবার (১৮ জুন) সকালে দক্ষিণ শ্রীপুর (চ্যাংমারী) গ্রামে লুৎফর রহমান (৩৫) আত্মহত্যা করেন।
তিনি মৃত আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দীর্ঘদিনের মানসিক সমস্যার কারণে ঘরের বাঁশের ধরনায় বিছানার চাদর পেঁচিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
পরপর পাঁচটি মৃত্যুতে সুন্দরগঞ্জজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাগুলোকে ‘বেদনাদায়ক’ ও ‘গভীর সামাজিক সংকেত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মানুষের মুখে এখন একটাই প্রশ্ন—
“এই মৃত্যু কি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি সমাজে জমে থাকা অভিমান, অবহেলা ও নিরব কান্নার প্রতিচ্ছবি?”
এইসব মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি তুলেছেন সচেতন মহল।
বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ মিলছে।
সুন্দরগঞ্জ এখন শুধু শোকাহত নয়—প্রতিটি মৃত্যু সমাজের গভীর অসুখের একটি দগদগে ঘা হয়ে উঠছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ আতাউর রহমান মুকুল
What's App: +8801710-489904 E-mail: db71pratidin@gmail.com